আমার মনখারাপ ও বেক-ম্যানিয়া #১

কী জানি কেন কিছু লিখতে গেলেই মনখারাপের কথা চলে আসে। দূরে ঠেলে রাখতে চাই, কিন্তু না, নাছোড়বান্দা প্রেমিকের মতো ঠিক সেই কাছ ঘেঁষে আসে। চুলে বিলি কাটে, আলগোছে ছুঁয়ে থাকে। ভাবখানা এমন যেন , কোথায় যাবে, পালাবার পথ তো নেই, সেকথা কি জানো না?!
নাহ, আজকাল মনখারাপের ফিরিস্তি লিখতে বড্ড বিরক্ত লাগে। এই মনখারাপ, এই ক্লান্তি আমার একার কিছু নয়, অনেককেই দেখি এই একই কথা বলতে। আগে এসব অনেক লিখেছি, আর নয়।
আমি আমার বেকিং ওয়ার্ডোব খুলে বসি। একটা একটা করে মিক্সিং বোল নামাই, বেছে বেছে মেজারিং চামচ আনি। ডাইনিং টেবিলে ঢাকনা পাতি। ময়দার কৌটো, গুঁড়ো চিনি, ভ্যানিলা এসেন্সের বোতল বের করে রাখি, ফ্রিজ থেকে নামাই আমার ঠান্ডা মনের মতো জমাট মাখন।কাপে মেপে নিয়ে ময়দা চালতে থাকি, বাটির মধ্যে ছোট্ট বরফের পাহাড়ের মত ময়দা জমে, কিছু উড়োঝুরো এদিক ওদিক উড়ে যায়, আমার এলোমেলো ভাবনার মতই। আমি যত্ন করে চিনি ঢালি, একদম মাপে মাপে ভ্যানিলা। এরপর মেশাই নিখুঁত টুকরো করে কাটা মাখনের টুকরো। ঠিক যতটা দরকার, ততটাই। আতিশয্য বা অভাব কোনোটাই চলে না এখানে। যেন ঠিক আমার ইউটোপিয়ার জীবন, ঠিক যেমনটা চাই, যতটুকু চাই, যেভাবে চাই, সেভাবেই। আমার আঙুলের তাপে গলে গলে মাখন মিশতে থাকে ময়দা, চিনিতে, না হাতের তালুর জোর নয়, আঙুলের কোমলতায়। ঠিক যেভাবে ব্যথানিবারণী স্পর্শ ছুঁয়ে যায় ক্ষতের উপর, সেরকম নরমে ময়দা ডো হয়ে যায়, আলগোছে ক্লিং ফিল্ম মুড়ে তাকে ফ্রিজে তুলে রাখি কিছুক্ষণের জন্য। ডো সুঠাম হয়, সুগঠিত হয় পরিমিত শীতের আদরে, আমি ততক্ষণ বেছে আনি মন মতো কুকি কাটার, প্রজাপতি, তারা, ফুল, হৃদয় ইত্যাদি নানা আকার যেগুলো কিনা রূপকথার বইতে থাকে, সেগুলোই আমার বেশি পছন্দের। সময় হলে ডো কে বার করে আনি পরম মমতায়, বেলনির অল্প চাপে তাকে মেলে দিই রোলিং বোর্ডের উপর। এবার নানান ছাপ আঁকি তার উপরে, হৃদয়, তারা, ফুল, প্রজাপতি ইত্যাদি নানা ছবি যেগুলো কিনা রূপকথার বইতে থাকে। আঁকি, তুলি, আবার বেলি, আবার আঁকি, এভাবেই ভরে আমার পার্চমেন্ট বিছানো বেকিং ট্রে। আগে থেকে উষ্ণ করে রাখা আভেনে যত্ন করে রাখি ওদের। নির্দিষ্ট তাপ ও সময় মাপ করে দিয়ে বলি, তৈরী হও, পুড়লে তবেই না নিখাদ হবে তোমরা। আভেন থেকে মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে আচ্ছন্ন করতে থাকে আমাকে, আমি মন্ত্রাচ্ছন্নের মত ক্রিম হুইস্ক করি, চকোলেট গলাই। আভেনের বুক থেকে বার করে আনি তুলতুলে কুকিদের। এবার ওরা ঠান্ডা হোক, আমি পরিষ্কার করে রাখি মিক্সিং বোল, গুছিয়ে তুলি মেজারিং কাপ, চামচ। পাইপিং ব্যাগে ভরি গলানো চকোলেট, ক্রিম। বাঁহাতের তালু আঁকড়ে ধরে ডানহাতের কবজিকে, বিস্কুটের বুকে ফুটে ওঠে চকোলেটের ফুল, ক্রিমের মেঘ ইত্যাদি নানান কিছু যেগুলো কিনা রূপকথার বইতে দেখা যায়। আমার প্রজাপতি বিস্কুটের ডানা রঙিন হয় রামধনু রঙ স্প্রিংঙ্কলস দিয়ে, আমার ফুলের পাপড়িতে ডানা মেলে শাদা ক্রিমের মেঘ , হৃদি আধা ভরে অবৈধ পাপের মতো গলিত চকোলেটের গাঢ় অন্ধকারে, অর্ধেক থাকে আমার বেফসলি মনের মত শূন্য এবং শাদা।
এভাবে আমার যাবতীয় মনখারাপের ফসলগুলো এয়ারটাইট কৌটোতে আটকে আমি ঘুমাতে যাই, খেয়াল করিনা বালিশে আগে থেকেই মাথা দিয়ে শুয়ে আছে মনখারাপের অন্য কোনো টুকরো।  



Comments

Popular posts from this blog

আনকথা #১২

অলিখিত #৪

অলিখিত #৩