নতুন বর্ষায়, ফিরে দেখা বসন্ত (পুরোনো ব্লগ থেকে)
সম্বচ্ছরের সব চাইতে মনকেমনের সময় এখন... বড় রঙ, বড্ড রঙিন চারদিক.... কলকাতা শহরে এত শিমুল গাছ আছে ফুল না ফুটলে কে জানতো? একেকটা গাছে কি অদ্ভুত রঙের কচিপাতা, কোনোটা স্বপ্নসবুজ ,পেঁয়াজখোসা রঙ কোনোটা, কোনোটা আবার হালকা বাদামী, যেন মোমপালিশ করা.. আমার অফিসের কাছে এক বহুতলের গেটে কাগজফুলের বন.. সাদা আর রাণীকালারে মারকাটারি.. সেক্টর ফাইভে যাওয়ার পথে লাইন দিয়ে পলাশ, অশোকফুল,অনেক অনেক রুদ্রপলাশ, শিমুল, জারুল ... সযত্নে লালিত কিছু নাম না জানা বুনোফুলে প্রজাপতিদের নিমন্ত্রণ.. মাঝরাতে কোকিল ডাকে এখানেও.. শেষদুপুরের উদাস হাওয়া এসে বলে যায় কে বলে এ শহর প্রাণহীন...তোমাদের প্রাণে প্রাণ নেই , তাই দেখেও দেখো না..
বিশেষ কারণে ইদানীং প্রায় যাতায়াত করছি ট্রেনপথে...ফিরছি আমার ফেলে আসা শহরতলীর দিকে... আসা যাওয়ার পথের ধারে জাগ্রত এ বসন্ত.....ভোরবেলার দিকে যখন আসি, মিষ্টি আলোয় স্নান করে মায়ের সিঁদুরটিপের মতো লাল সূর্যটা সবে আকাশে এসেছে...সে আলোয় ধুয়ে যায় রজনীগন্ধার ক্ষেত.. মুকুলের ভারে ভেঙ্গে পড়া ছোট্ট ছোট্ট আম্রপালীর গাছ.. শান্ত নয়ানজুলির জলে মুখ দেখা বাঁশবন.. না জানি কাদের উঠোনের ধারে লাল হয়ে থাকা মাদারগাছটা...রেললাইনের পাশ দিয়ে ফুটে থাকা অজস্র ভাঁটফুল, আকন্দ, অজানা নামের আরো কত ফুল ফুল মুখ ... ধুয়ে যায় দিগন্তছাপানো ধূ ধূ মাঠ... "যেখানে অনেক পথ খুঁজে পৃথিবী শুয়েছে চোখ বুজে এলিয়ে হৃদয়.. শিয়রে শিমুল শুধু একা চুপ করে রয়.." কত যে শিমুল..লাল, কমলা ... তাদের পাতাবিহীন ডালে ডালে অগ্নিশিখায় মাতোয়ারা নেশার নাম বসন্ত.. দেখতে দেখতে বুঁদ হয়ে যাই...
অনেক দিন পর সেদিন বিকেলে মেয়েকে নিয়ে গেছিলাম আমাদের ছোট্ট নদীটার ধারে... অস্ত আভা মেখে পাখিরা তখন ঘরের মুখে... অনেকটা বদলে গেছে নদীটা.. মাঝ বরাবর চর পড়ে গেছে..সেখানে কারা শাকের ক্ষেত বানিয়েছে কঞ্চির বেড়া দিয়ে.. মনে পড়লো আগে সাঁতরে নদীর ওপাড়ে ছোলার ক্ষেত থেকে ছোলা শাক নিয়ে আসা হতো.. সদ্য হওয়া সেই কচি ছোলার মিষ্টি স্বাদ মুখে লেগে আছে এখনো... নদীর পাড়ের বড় শিশুগাছটা আজ আর নেই..নেই তার মধ্যে বাসা করে থাকা টিয়ারাও... কচুরিপানারা আছে... একইভাবে ভেসে যাওয়া বছরের পর বছর...হালকা বেগুনি তাদের ফুলে মৌটুসী পাখির দল... অলসভাবে ভেসে থাকা জেলে নৌকাগুলো একইরকম আছে আর আমাকে আগের মতনই বিস্মিত করে নদীটা সেই অমনি করেই বাঁক নিয়েছে আজও.. এতগুলো দিনেও জানলাম না ওই বাঁকের ওপাশে ঠিক কী আছে... মেয়ের অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হঠাত দেখলাম দক্ষিণ পুব কোণ থেকে মেঘের দল আসছে...বাতাসে বহুদূরের বৃষ্টিগন্ধ...পাশের সাহেব ক্যাম্পের বড় মাঠটার ধার ঘেষে দাঁড়ানো ইউক্যালিপ্টাসগুলো হঠাৎই অস্থির হয়ে উঠলো...এক ঝলক ঘূর্ণী হাওয়া এসে শুকনো শালপাতাগুলোকে মাঠময় ছড়িয়ে টরিয়ে বেয়াড়াপনা শুরু করে দিলো...আচমকা শুরু হলো বিদ্যুৎ চমকানো.. রুপোরঙ তলোয়ার দিয়ে কালোমেঘ চিরে চিরে কাদের যেন সে কী এক যুদ্ধ শুরু হওয়ার তাল...আমার মেয়ে তার ছয় বছরের দীর্ঘ জীবনে এই দৃশ্য আগে দেখেনি..কিছুটা ভয়ে কিছুটা উত্তেজনায় বললো, "মা, ছুটি?" অগত্যা ছুটি...ছুট ছুট... বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার আগেই অকালবৈশাখী.... চুল, মুখ ধুলোয় ভর্তি...কি আর করা, বসন্ত তো কিছুটা বেনিয়মের নামও বটে..
কদিন আগেই দোল গেলো .... আমার খুব প্রিয় উৎসব , যদিও এবার প্রায় বারো বছর পর আমি রঙ খেললাম.... মেয়ে রঙ মেখে ভুতের ছানা হলো... ভাইয়ের ছোট্টছেলেটার সাথে মিলে প্রচুর জলবেলুন ফাটালাম... অনেক আবীর মাখলাম... উড়ালাম মুঠো করে.... বাতাসে মিশে যাওয়া সে সুগন্ধ মনে করিয়ে দিলো কতকিছু........
ঝকঝকে কাঁসার বারকোশের মত চাঁদটা...রেললাইনের ধারের নির্জন রাস্তায় বড় বড় শালগাছের প্রহরা... বাতাবিফুল আর আমের বোলের ঝিমঝিম গন্ধ.. এলোমেলো বাতাসে উড়তে থাকা চুল.. মাঝে মাঝে কুউউউ ঝিকঝিক করে বেরিয়ে যাওয়া ট্রেনের হঠাৎ আসা আলো চমকে দিয়ে মনে করিয়ে দিয়ে যেতো অনেকটা পথ হেঁটে এসেও কোনো কথা বলা হলো না কারোরই... সেই না বলা কথার গভীর আলো নিয়ে তারপর একে একে জোনাকি ফুটলো... ছায়াপথে তারারা এলো ভিড় করে ... আর চিরস্থায়ী এক মনখারাপের অসুখে কে বা কারা পড়লো, যেই অসুখের আরেক নাম বসন্ত...
Comments
Post a Comment