আন-কথা # ২

চলে যাওয়া শ্রাবণের পথে, ঝরে থাকা কদমের রেণু যত দূর
ততোধিক দূর কোনো পরবাসে, লেখা হোক ঠিকানা আমার।

সুগত, সেই কবে এই দুই লাইন লিখেছি। শ্রাবণের পথ ধরে তারপর তো গেলো আশ্বিন, অমলধবল পালে মন্দমধুর হাওয়া লাগলো এই শহর কলকাতার আকাশেও, সময়মতো চলেও গেলো। বাড়ি ফেরার পথে অঘ্রাণের বিষণ্ণ সন্ধ্যায় আনমনা এলাম কতদিন।

নীল, বিষণ্ণ সন্ধ্যা- সেই কবেকার আমার ছেড়ে আসা মফস্বলে যেমন সন্ধ্যা নামতো, কারা যেন ঝরা পাতায় আগুন দিতো শেষ বিকালে, সেই ধোঁয়ার কুন্ডলী নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়তো সারা পাড়াময়। টিউশন ক্লাশে যাওয়ার পথে চোখে পড়তো ভাঙা পাঁচিলের উপর একা পেঁচা আর আকাশে সন্ধ্যাতারার ফুল। রাস্তার পাশে ঢোলকলমীর ঝোপে জলসা শুরু করতো ঝিঁঝিরা, একে একে জোনাকি ফুটতো। দূর থেকে ভেসে আসতো সংকীর্তনের একঘেয়ে বোল।
অঘ্রাণের কথায় মনে এলো, কতদিন জীবনানন্দ পড়িনি। শুধু জীবনানন্দ কেন, কোনও কবিতাই পড়িনা কতদিন । লেখা- তার কথা না বলাই ভালো।

সুগত, আজকাল কবিতার খাতা তুলে রাখি দেরাজ গহনে...

না, খাতা তো নয়, খাতা তো নেই...তবু ভাবতে ভালো লাগে বেশ একটা বাদামী চামড়ার মোটা বাঁধানো খাতা, আকাশী নীল পাতায় রুলটানা। সেখানে ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখি কিছু কবিতার মতো।

কিন্তু লিখবোই বা কী! যা কিছু বলতে চাই, দেখি ঢের আগে বলে গেছে কেউ, আরো বেশি প্রাণঢালা, আলো আর গীতিসুধাময়। আমি সে শব্দসরণি ধরে ধীরে হাঁটি, দেখি আমারই সে কথাফুলে সে পথের দুপাশ রঙিন, মলয়বাতাসে আমারই অনুচ্চারিত ভাবনার ঘ্রাণ। আমার রাগ হয়, আমার হতাশ লাগে। এই অকাজের আমিটাকে নিয়ে আমি কী করি বলোতো!

বিগত সন্ধ্যার মনখারাপ বয়ে নিয়ে আমার রাত নামে, এখানে জোনাকি নেই, লেবুফুলের গন্ধভরা চাঁদে ভেজা বারান্দা নেই, মিশকালো রাত্তিরে নাইটকুইনের ঝোপ থেকে ডাহুকের  ডেকে ওঠা নেই। আছে শুধু আশিরনখর ক্লান্তি, অনির্দিষ্টকাল ঘুমে হারিয়ে থাকলেও যা যায় না, যেতে চায় না।

শহরজুড়ে এখন শীতের মৌতাত। বছরশেষের দিনগুলো ছুটির মেজাজে  রঙীন, আলোকজ্জ্বল। তুমি তো জানো সুগত, আমি উৎসবে গা ভাসাতে পারি না, দূর থেকে দেখেই আমার ভালো লাগে।

এরকম শীত সন্ধ্যায় আমার কখনো না করা কিছু অলীক ইচ্ছে করে।  জ্যোৎস্নাস্নাত লবটুলিয়া বইহারের সেই একাকী ঘোড়সওয়ারের সাথে জুটে যেতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে সরস্বতীকুন্ডীর বুকে তারাদের ছবি দেখে কল্পনা করে নিতে কোনো একান্ত নক্ষত্রমন্ডল, জেগে উঠতে ইচ্ছা করে কোনো বরফঢাকা হ্রদের পাড়ে যেখানে জাদুকরী ভাসিলিসা তার জাদুর কাঠিতে ভাসিয়ে দেয় রাজহাঁসের জোড়া, আপেল গাছে টুকটুকে লাল আপেল ধরে।

এসব শুনে তুমি তো হাসো সুগত, বিশ্বাস করো, আমারও হাসি পায়। এই প্রাত্যহিকতায় বিধ্বস্ত আমিটার এ হেন আকাশকুসুম ভাবনায় আমারও হাসি পায়। আমার কান্না পায়। আমি মনে মনে কামনা করি কোনও দীর্ঘ অসুস্থতা। অসুখের ছলে হলেও কিছু বিশ্রাম, উৎকন্ঠামাখা কিছু প্রিয়মুখ, কিছু ব্যথাহর ছোঁয়া, আহা চন্দন...চন্দন... দৃষ্টিতে কী শান্তি দিলে!!

একটা খুব বড় রকমের প্রলয় আসতে পারে না, সুগত, আগামীতে কোনওদিন?!

Comments

Popular posts from this blog

আনকথা #১২

অলিখিত #৪

অলিখিত #৩