আন-কথা #৬


কাচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশ আর মেঘ- তুলোর মতো মেঘ, ভ্যানিলা আইসক্রিম স্কুপের মতো মেঘ, সুখস্বপ্নের মতো মেঘ। অনেকটা উঁচুতে পাক খাওয়া একলা চিল, ডানায় যার নাকি রৌদ্রগন্ধ। শরতের উজ্জ্বল বেলা, আচমকা আসা উত্তাল হাওয়ায় উড়ে যায় সামনের ছাদে মেলে দেওয়া ডুরে শাড়ি। দেখতে দেখতে উত্তর-পশ্চিমে কালো হয়ে এলো। দক্ষিণের সাদা আর উত্তরের কালো মেঘে না জানি কী মান অভিমান হলো, একপশলা ঝরে গিয়ে আবার ঝলমলিয়ে উঠলো আকাশের ক্যানভাস। সারাদুপুর এলোমেলো হাওয়া শান্ত হয় যখন সপ্তাশ্ব চলেছে ফেরার পথে। কী মায়াময়, অপার্থিব আলোর ফুল সারা আকাশ জুড়ে....দেখতেই থাকি, দেখতেই থাকি।

বিশ্রাম- বহু প্রতীক্ষিত সেই বিশ্রাম আমার। সারাদিন সামান্য কিছু কাজ আর অনেক বিশ্রাম, ঘুম- সুখের জন্য এর বেশি আর কী প্রয়োজন!"অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন..." 

ভরার তো কথাই,কিন্তু...এক বিশালাকার কিন্তু ছায়া ফেলে আছে দিনযাপনে...

সামান্য কিছু শারীরিক অস্বস্তি আর পাহাড়প্রমাণ ক্লান্তিতে ভেঙে যেতে যেতে জানলাম এই করোনাকাল ছুঁয়েছে আমাকেও। তারপর থেকেই শুরু এই নির্বাসনের বিশ্রাম। শারীরিক অসুবিধার সাথে ওই উত্তর-পশ্চিমের মেঘের মতই ঘন হয়ে আসে মনখারাপ, আমার জন্য বিপদে পড়তে পারে কাছে আসা, কাছে থাকা মানুষেরা। অনেক বিশ্রামেও সেই মনের ভার যায় না। সকলে খোঁজ নেয়, আরোগ্য কামনা করে, অন্যমনস্ক ভাবে কথা বলি। সবসময় ফোন ধরতেও ইচ্ছে করে না, ইচ্ছে করে না মেসেজের উত্তর দিতে। স্নায়ুকোষে চুঁইয়ে ঢোকে বিষাদজনিত ক্লান্তি, বিশ্রাম অবশ্যই যার প্রতিকার নয়। 

ইচ্ছে-অনিচ্ছেতে সারাদিন যেটুকু স্বাভাবিক পরিশ্রম করি, তার সিকিমাত্র করতে গেলে জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে; নানান কিছু খাবার খাওয়ার কথা বলে শুভাকাঙখীরা, আমি বুঝিয়ে বলতে পারিনা সে আয়োজন করার মতো শারীরিক সামর্থ্য বা ইচ্ছেটুকুও আমি খুঁজে পাইনা; বাড়ির কাজের সহায়িকা মেয়েটি আসে গাছে জল দিতে, দরজার বাইরে থেকে শুনি ছাদের বাগান আলো হয়ে আছে ফুলে, আমি দেখতে পারি না, ছুঁতে পারি না - প্রতিদিন সকালে নিজেকে যেন কোন অতল থেকে টেনে তুলছি, সারাদিনের শেষ আবার ঠিক সেইখানেই। সারাজীবনের মতো হারিয়ে ফেলা দুটো ডাকের কাছ ফিরতে ইচ্ছে করে বারবার...

এই কদিনে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এটাই যে এই অসুখ শরীরের সাথে সাথে মনকেও বিষাদবিষে ভরে দেয়, অনেক বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার, ঘুমেও তা যায় না। 

এই কদিনের আস্তানা, যার নাম আমি দিয়েছি করোনা কর্ণার, সেখান থেকে জানলার ফাঁকে আটকে থাকা ওই একটুকরো আকাশ, ওই মেঘেদের ভেসে যাওয়া, একলা চিলের ডানা বা হঠাৎ আসা একপশলা বৃষ্টি আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় এই বিষাদকথন, প্রতিদিন একটু একটু করে। 

 এই ক্লান্তিভার কবে নামবে জানিনা। 

Comments

Popular posts from this blog

আনকথা #১২

অলিখিত #৪

অলিখিত #৩